ভিতরগড়ঃ
নামকরণ নিয়ে বহু ধরনের মতামত থাকলেও পঞ্চগড় নামটির উৎপত্তি যে এ অঞ্চলের প্রধান পাঁচটি গড়ের স্মৃতিকে ধারণ করে এটি প্রায় নিশ্চিত। গড় গুলো হলো- ভিতরগড়, মিরগড়, হোসেনদিঘিরগড়, রাজনগড়, ও দেবেনগড়। পঞ্চগড় শহর থেকে ১০ মাইল উত্তরে বাংলাদেশ-ভারত সীমামত বরাবর পঞ্চগড় সদর উপজেলাধীন অমরখানা ইউনিয়নে অবস্থিত এই গড়। প্রাচীনকালে উত্তরবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে যেসব রাজ্যের কথা উল্লেখ রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে পঞ্চগড়ের ’ভিতরগড়’ উল্লেখযোগ্য। আয়তনের দিক থেকে ’ভিতরগড়’ দূর্গনগরী ছিল বাংলাদেশের মধ্যে সর্ববৃহৎ। প্রায় ১২ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ভিতরগড়ের অবস্থান।উপজেলা সদর দপ্তর হতে প্রায় ১৫ (পনের) কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থিত ভিতরগড় দুর্গনগরী প্রাচীন যুগের একটি বিরাত কীর্তি। প্রায় ১২ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে এই বিশাল গড় ও নগরীর অবস্থান। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর বর্তমান এ দুর্গনগরীর কিছু অংশ ভারতের মধ্যে পড়েছে। ঐতিহাসিকদের মতে ভিতরগড় পূর্ণ নির্মাণ করেন প্রাচীন কামরুনের শুদ্রবংশীয় রাজা দেবেশরের বংশজাত পৃথু রাজা। সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় পৃথু রাজার অভ্যূলয় ঘটে। তিনি কামরুপে পরাজিত হয়ে ভিতরগড় এলাকায় গমন করেন এবং নির্মাণ করেন এই গড়। ভিতরগড় দুর্গে একটি বড় দিঘী (মহারাজার দীঘি) ও কয়েকটি ছোট ছোট দীঘি আছে এবং এর ভিতরে মন্দির, প্রসাদ ও ইমারতের এবং সাবশেসে এবং বাইরে পরিখা ও মানীর প্রাচীর এখনো দেখা যায়।
ভিতরগড় মূলত একটি প্রাচীন দুর্গনগর। বাংলাদেশে যে কটি গড়ের সন্ধান মিলেছে আজ অবধি, তার মধ্যে মহাস্থানগড় প্রাচীনতম দুর্গনগর হিসেবে বিবেচিত হলেও আয়তনের দিক থেকে ভিতরগড় দুর্গনগরই সম্ভবত সর্ববৃহৎ। ভিতরগড় দূর্গ নির্মাণের সঠিক কাল এখনো নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। তবে সম্পুর্ন দূর্গট একই সময়ে নির্মিত হয়নি। ধারনা করা হচ্ছে, ভিতরগড় দুর্গ নির্মাণের সঙ্গে কামরূপের শূদ্রবংশীয় রাজা দেবেশ্বরের বংশজাত পৃথু (পৃথ্বী) রাজার নাম সম্পৃক্ত। আনুমানিক ষষ্ঠ শতকের শেষার্ধে সম্রাট হর্ষবর্ধনের সময় কামরূপের কোনো এক যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে রাজা পৃথুর আগমন ঘটে এই এলাকায়। এখানে তিনি গড় নির্মাণ করেন, স্থাপন করেন নতুন রাজ্য। অতঃপর পাল বংশীয় রাজাদের দ্বারা এই অঞ্চল অধিকৃত ও শাসিত হওয়ার কালে গড়ের আয়তন বেড়ে যায়। এই নগর চারটি দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। এর বাইরের দুটি গড় বা দেয়াল মাটি দিয়ে বানানো। ভেতরের দুটি দেয়াল ইটের তৈরি। এসব স্থাপনার গাঁথুনি মাটির বিনির্মাণ কৌশল বৌদ্ধদের প্রাচীন আবিষ্কৃত দুর্গের মতোই। প্রাচীরগুলো ১৩ থেকে ১৮ ফুট উঁচু এবং সাত তেকে ১২ ফুট প্রশস্ত। সামনে আছে বিশাল একটি দিঘি। ভিতরগড়ের যত্রতত্র ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে প্রাচীন ইট ও ইটের টুকরা। দুর্গপ্রাচীর কেটে বাড়িঘর নির্মাণ করেছেন কেউ কেউ। এই দুর্গনগরের অমূল্য প্রত্নসম্পদ অযত্ন-অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংস হতে চলেছে।
কেন গুরুত্বপুর্নঃ
১৮০৯ সালে ড. বুকানন হেমিলটন পরিদর্শন করেছিলেন এই গড়টি। তাঁর বর্ণনানুসারে মোট চারটি অভ্যন্তরীণ গড়ের সমন্বয়ে গঠিত ছিল ভিতরগড় দুর্গনগর। গড়গুলোর অবস্থান ছিল একটি অপরটির ভেতর। সবচেয়ে ভেতরের গড়ে নির্মিত হয়েছিল রাজা পৃথুর প্রাসাদ। তবে সেসব কীর্তি এখন দৃশ্যমান তো নয়ই, অনুধাবনযোগ্যও নয় মোটেই। পঞ্চগড়ের ভিতরগড়ে পাওয়া গেছে প্রায় দেশ হাজার বছরের পুরনো নিদর্শন। এখানে কোন্ ধর্ম বা সম্প্রদায়ের লোকজন বসবাস করতেন এবং তাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবন কেমন ছিল এ বিষয়ে এখনও তেমন কোনো ধারণা পাওয়া যায়নি। তবে প্রত্নতাত্ত্বিকরা মনে করছেন ভিতরগড় এলাকা ছিল একটি গরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিককেন্দ্র। ভিতরগড়ের প্রত্নস্থলটি প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের সংলগ্ন অবস্থিত হওয়ায় এ এলাকার অধিবাসীরা নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, তিব্বত, চীন, বিহার ও বাংলার সঙ্গে ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন। অমরখান্দা ইউনিয়নের ‘ভিতরগড়’ গ্রামে অবস্থিত এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে করোতোয়ার শাখা তালমা নদী। এখানে সন্ধান মিলেছে চারটি দুর্গ প্রাচীরের মাঝখানে একটি মন্দির এবং ইমারত। ধারণা করা হচ্ছে, এগুলো প্রায় দেড় হাজার বছরের পুরনো।
পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে: মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, এটুআই, বিসিসি, ডিওআইসিটি ও বেসিস